সকালে বন্ধু আসিফের ফোন পেয়ে ঘুম ভাঙল। ফোনটা রিসিভ করতেই অপর প্রান্ত থেকে আসিফ বলে উঠল, ‘সুপ্রভাত দোস্ত।’ আসিফের মুখে ‘সুপ্রভাত’ কথাটি শুনে আমি যেন হঠাৎ আকাশ থেকে পড়লাম! কারণ যে বন্ধু জাগরণে দূরে থাক, গভীর রাতের স্বপ্নেও কোনোদিন বাংলায় কথা বলতে চায় না, তার মুখ থেকে আচমকা এরকম খাঁটি বাংলা শব্দ শুনলে চমকে যাওয়ারই কথা। যাই হোক, দেরি না করে জিজ্ঞেস করেই ফেললাম, কিরে, আজ হঠাৎ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের উপস্থাপকদের মতো এমন শুদ্ধ বাংলায় উইশ করলি যে? জবাবে আসিফ বলল, তুই জানিস এটা কী মাস? বললাম, হুম... জানি। এটা ফেব্রুয়ারি মাস, তাতে কী?
— তাতে কী মানে? তুই জানিস না এটা আমাদের ভাষা আন্দোলনের মাস? বলল আসিফ।
— এটাও জানি, কিন্তু ভাষা আন্দোলনের মাস বলে হয়েছেটা কী?
এবার আসিফের মুখে শুনতে পেলাম রাগী একটা স্বর। সে বলতে লাগল, আরে ব্যাটা, ভাষা আন্দোলনের মাসে দেশের প্রতি আমাদের একটা কর্তব্য আছে না! যে ভাষার জন্য মানুষজন প্রাণ দিয়েছে, সেই ভাষার জন্য প্রাণ না দিই কিন্তু সব ভাষাশহীদের প্রতি কি আমরা একটু শ্রদ্ধাবোধও দেখাতে পারি না?
— অবশ্যই পারিস। কিন্তু কীভাবে দেখাবি বল?
— কেন, এই যে এভাবে? এই মাসে বেশি বেশি বাংলা ওয়ার্ড ইউজ করে!
আসিফের এমন জগাখিচুড়িমার্কা কথা শুনে যে কারোরই রাগ উঠতে পারে। আমারও উঠল। বললাম, সারা বছর ঠুসঠাস ইংরেজিতে কথা বলে কেবল একটি মাস বাংলায় কথা বলার রেওয়াজ করলেই বুঝি তা ভাষার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ দেখানো হয়ে যায়, তাই না রে? এবার খানিকটা চুপসে গেল আসিফ। কয়েক সেকেন্ড বিরতি নিয়ে হঠাৎ ঠাস করে বলে বসল, শালা তুই একটা রাজাকার! তোর নিজের তো ভাষার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নেই-ই, উল্টো আমাদের মতো তরুণ প্রজন্মের ভাষাপ্রেমীদের ওপর আক্রমণ করাটাই যেন তোর কাজ! এবার আসিফের কথায় আমি না হেসে পারলাম না! তবু আর বেশি কথা না বলে বিষয়টাকে এখানেই থামিয়ে দিলাম।
এরপর আসিফের সঙ্গে কথা শেষ করে বিছানা থেকে উঠে হাত-মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হলাম। একটু পর কলেজে যেতে হবে, তাই নাস্তার জন্য অপেক্ষা করছি। নাস্তা রেডি হতে হতে ভাবলাম, ফেসবুক থেকে একটু উঁকি মেরে আসা যাক। ব্যস, বসলাম কম্পিউটারে। ফেসবুক লগইন করামাত্রই দেখি আরেক কাণ্ড! নিজের হোমপেজ আর বন্ধুদের প্রোফাইল পিকচারজুড়ে শুধুই বাংলা বর্ণমালার বিভিন্ন অক্ষরের ছড়াছড়ি! হঠাৎ-ই বড় ধরনের কোনো অক্ষরবিপর্যয় হলো কিনা চিন্তায় পড়ে গেলাম! এমন সময় আমার এক বন্ধু অর্ণব চ্যাট বক্সে কড়া নাড়ল। তার প্রোফাইলেও দেখি বড় করে লেখা আছে বাংলা বর্ণমালার ‘অ’ বর্ণটি। তাই জিজ্ঞেস করলাম, তোর প্রোফাইলে ‘অ’ লিখে রেখেছিস ক্যান? এর মানে কী? অর্ণব বলল, ‘অ’-তে ‘অর্ণব’ মানে তার নিজেরই নাম!
— তাহলে শুধু ‘অ’ ক্যান? পুরো নাম লিখলেই তো পারিস!
— আরে না। যার নাম যে অক্ষর দিয়ে শুরু, শুধু ওই অক্ষরটি দিলেই বেশি সুন্দর লাগে!
— তাহলে জাতীয় পরিচয়পত্রের ছবিটা মুছে ওখানেও একটা অক্ষর ঝুলিয়ে রাখ! এতে নিজের বীভত্স চেহারাটা আর কাউকে দেখাতে হবে না, আবার দেখতেও সুন্দর লাগবে!!
— দেখ, এটা নিয়ে কোনো তামাশা করবি না। সহ্য করব না বলে দিলাম।
— আচ্ছা যা, করলাম না; কিন্তু তোরা সবাই এই অক্ষরগুলো দিয়ে কী প্রমাণ করতে চাস, এটা তো বলতে পারিস?
— প্রমাণ করতে চাই মানে? এটা হলো আমাদের মাতৃভাষা- প্রেম। বাংলাকে যে আমরা কতটা ভালোবাসি তা বিশ্বকে জানাতে হবে না!
— ও! ফেসবুক আইডিতে নিজের ছবির জায়গায় বর্ণমালার একটি অক্ষর দিয়ে রাখলেই যে এটা মাতৃভাষার প্রতি প্রেম হয়ে যায়, তা আমার জানা ছিল না!
ইতোমধ্যেই অর্ণব একটা লিংক পাঠিয়ে দিয়ে বলল, এখান থেকে তুই ও নিজের নামের প্রথম অক্ষরটা সুন্দরভাবে বানিয়ে প্রোফাইলে সেট করতে পারবি।
আমি আর কোনো রিপ্লাই না দিয়ে সোজা লগ আউট হলাম। এরপর ফেসবুক থেকে বের হয়ে সোজা কলেজের পথে পা বাড়ালাম।
কলেজে এসে প্রথমেই দেখা হয়ে গেল বন্ধু রাসেলের সঙ্গে। রাসেলের বেশভূষার দিকে নজর দিয়ে আমি অবাক না হয়ে পারলাম না! যে বন্ধু সারা বছর চুলে জেল দিয়ে ঘুরে বেড়ায়, সে কিনা আজ এসেছে খাঁটি সরিষার তেল মেখে! আবার পরনে চিরচেনা থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট এবং ইংলিশ জার্সির বদলে সে পরে এসেছে সিম্পল একসেট পাঞ্জাবি-পাজামা! এখানেই শেষ নয়, দেখি তার পাঞ্জাবিতে আবার লেখা রয়েছে দেশীয় সব বর্ণমালা! আগের দুই বন্ধুর ঘটনায় বুঝতে বাকি নেই যে, রাসেলের এই পরিবর্তনের কারণও হচ্ছে ভাষার প্রতি প্রেম! তাই তাকে আর অযথা কোনো প্রশ্ন করলাম না। চুপচাপ ক্লাসে চলে গেলাম। ক্লাস শেষে দুপুরে কলেজ ক্যান্টিনে গেলাম হালকা কিছু খাওয়ার জন্য। মজার ব্যাপার হলো, বন্ধুদের মতো ক্যান্টিনের চেহারাও আজ বদলে গেছে! ক্যান্টিনে ঢুকেই আজ আর শীলা-মুন্নি বা চিকনি চামেলীর গান শুনতে হলো না। এদের পেছনে ফেলে ক্যান্টিনের টেপরেকর্ডারে বাজতে থাকল সালাম-বরকত-রফিক-জব্বারের গান! ক্যান্টিন বয়কে বললাম—কী রে, ভাষা আন্দোলনের মাস বলে বুঝি আজ হিন্দি গানের বদলে পুরনো দিনের বাংলা গান বাজাচ্ছিস? বয় হেসে বলল, অ্যাগেইন জিগায় মামু! শত হইলেও এইটা ভাষার মাস। এ মাসে কি আর হিন্দি গান বাজানো যায়? এরপর আর কোনো কথা নয়। ক্যান্টিন থেকে দু’টি সিঙ্গাড়া আর এক কাপ চা খেয়ে বেরিয়ে পড়লাম।
দুপুরে বাসায় ফিরেও দেখি সারাদিনের সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি! অর্থাৎ আবারও ভাষা-প্রেম। এবারের প্রেমটা আর বন্ধুদের নয়, এটা স্বয়ং আমার ভাবীর! বাসায় ফিরেই দেখতে পেলাম ভাবী তার চিরচেনা হিন্দি সিরিয়ালের বদলে বাংলা নাটক দেখছেন টিভিতে। যদিও অবাক হওয়ার কিছু নেই, তবু প্রশ্ন করে বসলাম, ভাষার মাসের কারণে বুঝি এই মাসে আর হিন্দি সিরিয়াল দেখবেন না, তাই না? ভাবী মুচকি হেসে জানান, ঠিক ধরেছিস। এ মাসে আর নো মোর হিন্দি সিরিয়াল। এখন থেকে টিভি দেখব বাংলায়, কথাও বলব বাংলায়! ভাবীর কথায় কিছুটা স্বস্তি পেলাম। কারণ তিনি হিন্দি সিরিয়াল দেখতে দেখতে হিন্দি ভাষাটাও আয়ত্ত করে ফেলেছেন। যার ফলে কথা বলার সময় বাংলা-হিন্দি মিশিয়ে তিনি এমন কিছু শব্দ বলে বসেন, যা বুঝতে গেলে আমাদের প্রায় দাঁত ভাঙার উপক্রম হয়! এ মাসের উছিলায় অন্তত কিছুদিন তার এমন উদ্ভট কথা থেকে নিস্তার পাব এটা ভেবেই স্বস্তি লাগল। এরপর ভাবীর কাছে জানতে চাইলাম, কাজের বুয়া কোথায়? সে আজ আসেনি? ভাবী বললেন, না আসেনি। তাকে কী দরকার? বললাম, চা খেতে ইচ্ছে করছিল। কিন্তু বুয়া তো আসেনি। এখন কী করে যে খাই? এবার আমাকে অবাক করে দিয়ে ভাবী বলে উঠলেন —
‘উসকে লিয়ে টেনশান নেহি লেনেকা! ম্যায় হু না!!’
যাই হোক, ভাবীর কাছ থেকে মুক্তি পেয়ে বিকেলে টিউশনিতে গেলাম এক ছাত্রীর বাসায়। সারা দিনের ঝক্কি-ঝামেলার পর এ সময়টায় নিজেকে খুব ক্লান্ত মনে হয়। ছাত্রীর মা শরবত তৈরি করে দিলেন খাওয়ার জন্য। সঙ্গে দিলেন বিস্কুট আর চানাচুর। হঠাৎ নিশাত (ছাত্রীর নাম) বলে উঠল, স্যার, আম্মু বলেছে আজ বেশি করে বাংলা হ্যান্ডরাইটিং করাতে। হায়! এখানেও দেখি সবার মধ্যে ভাষাপ্রেম! কী আর করা! নিশাতকে বললাম ঠিক আছে, 'বাংলা আমার মাতৃভাষা' এই লাইনটি ২০ বার লেখ। নিশাত লিখতে বসে গেল। নিশাত পড়ে ক্লাস থ্রি তে। ইংরেজিতে সে পটু হলেও বাংলায় খুবই কাঁচা। অতএব ২০ লাইন লিখতে তার মিনিমাম ১ ঘণ্টা লাগার কথা। তাই নিশাতকে লিখতে দিয়ে আমি বসে পত্রিকা পড়ছিলাম। আমাকে অবাক করে দিয়ে মাত্র ২০ মিনিটেই নিশাত বলল, স্যার লেখা শেষ! সব ঠিকঠাক আছে কি না চেক করার জন্য নিশাতের খাতাটা হাতে নিলাম। খাতার দিকে তাকাতেই আমার চোখ প্রায় কপালে! কারণ নিশাত 'বাংলা আমার মাতৃভাষা' কথাটি ২০ বার লিখেছে ঠিকই, কিন্তু তার লেখার ধরন ছিল এ রকম —
Bangla Amar Matri Basha...
 
Bangla Amar Matri Basha...
 
Bangla Amar Matri Basha!!!
 
লেখক: রবিউল ইসলাম সুমন
যৌথপ্রকাশ: ঘোড়ার ডিম, কালের কণ্ঠ (১৭ ফেব্রয়ারি ২০১৩)
ভিমরুল, আমারদেশ (২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৩)