থাকব না'ক বদ্ধ ঘরে
দেখব এবার জগৎটাকে...
ছোটবেলায় পড়া কবিতার এই লাইন দুটি একেবারে ফেভিকলের আঠার মতো মনের মধ্যে গেঁথে আছে বন্ধু আসিফের! আর তাই সে ঘরের চেয়ে বাইরে ঘুর ঘুর করে সময় কাটাতেই বেশি পছন্দ করে। যেকোনো সভা-সমাবেশ আর রাজনৈতিক মিছিল-মিটিংয়ে আসিফের থাকা চাই-ই চাই। এর মানে এই নয় যে সে একজন সংস্কৃতিমনা মানুষ বা কোনো রাজনৈতিক দলের সক্রিয় সদস্য। আসিফ এগুলো করে বেড়ায় দু-চার পয়সা ইনকাম আর পেট পুরে এক বেলা খাওয়ার আশায়!
আসিফের মুখে শুনেছি, এসব সভা-সমাবেশ আর মিছিল-মিটিংয়ে উপস্থিত থাকলেই নাকি নানা কিসিমের খানাখাদ্য আর কিছু পয়সাপাতিও পাওয়া যায়। আর এসবের লোভে সরকারি-বেসরকারি প্রায় সব দলের মিছিল-মিটিংয়েই যোগদান করত সে।
আসিফের ভাষ্য মতে, সে একজন সাহসী পাবলিক। আর তাই বিভিন্ন দলের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে প্রথম সারিতেই তার অবস্থান। হরতাল, অবরোধ, বিক্ষোভের মতো বড় বড় কর্মকাণ্ডের নেতৃত্বও নাকি দেয় সে। আর প্রতিটি কর্মসূচির পর পরই এগুলোতে তার সাহসিকতার অবদান তুলে ধরে বন্ধু মহলের সামনে। কোন হরতালে কয়টা গাড়ি পুড়িয়েছে, ইটের আঘাতে কয়জন পুলিশকে আহত করেছে এবং কয়টা রিকশার হাওয়া ছেড়েছে- এসব ঘটনা অবলীলায় বলে বেড়ায় বন্ধুদের সামনে। আর এ ঘটনাগুলোই নাকি তার অতি সাহসিকতার নমুনা!
যা-ই হোক, একদিন আসিফ বন্ধু মহলে হরতালের দাওয়াত দিল। মানে রাজপথে মিছিল, ভাঙচুর আর পিকেটিংয়ের নেমন্তন্ন আর কী! আসিফ জানায়, এবারের হরতাল বেশ কড়াকড়ি হবে, তাই এর জন্য অনেক লোকের দরকার। তাছাড়া মিছিলে উপস্থিত থাকলেই নাকি জনপ্রতি ১০০ টাকা এবং এক বেলা খাওয়ারও ব্যবস্থা আছে। দারুণ সুখবর! বন্ধু মহলের সবাই যেহেতু বেকার, তাই ভেবেছিলাম এমন আকর্ষণীয় অফার পেয়ে মিছিলে যেতে সকলে এক পায়ে খাঁড়া থাকবে। কিন্তু না। পরিবারের নিষেধাজ্ঞা আর হামলা-মামলার ভয়ে কেউই আসিফের প্রস্তাবে রাজি হলো না। একমাত্র আমিই রাজি হয়ে গেলাম আসিফের সঙ্গে হরতালের মিছিলে যোগ দিতে। মিছিল করলে টাকা পাব এর জন্য নয়, আমি রাজি হয়েছি বন্ধু আসিফ এত দিন নিজের সাহসিকতার যে গল্পগুজব করে আসছে, সেগুলো কত ভাগ সত্য এটা নিজ চোখে দেখতে।
কথামতো হরতালের দিন সকালে দেখা করলাম বন্ধু আসিফের সঙ্গে। হরতালের পক্ষে বিভিন্ন স্লোগান সংবলিত একটি বিশাল ব্যানার নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আসিফ। আমাকে দেখে ব্যানারটি ধরে দাঁড়াতে বলল সে। আমিও তা-ই করলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই শ-খানেক লোক জড়ো হয়ে গেল মিছিলে যোগ দিতে। আমি আর আসিফ ছিলাম একেবারে প্রথম সারির মাঝামাঝি। ইতিমধ্যেই এলাকার কিছু বড়ভাই ওরফে দলীয় নেতা-কর্মী এসে যোগদান করলেন আমাদের সঙ্গে। আমাদের নির্দেশ দেওয়া হলো, এলাকা থেকে মিছিলটি বের করে শহরের বিভিন্ন অলিগলি আর সড়ক প্রদক্ষিণ করে আমরা যেন আবার নিজ এলাকায়ই সমবেত হই।
বড়ভাইদের নির্দেশে মিছিল নিয়ে সামনের দিকে অগ্রসর হতে থাকলাম আমরা। মিছিলটি এলাকার গলি ছেড়ে মূল সড়কের কাছে যেতেই হঠাৎ শোনা গেল বিকট শব্দ। আর এই শব্দ শুনে কান দুটি একেবারে গরম হয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গেই ধোঁয়ায় ছেয়ে গেল আমাদের চারপাশ। বুঝতে বাকি নেই যে আশপাশে কোথাও ককটেল বিস্ফোরণ হয়েছে। আর তাই মিছিলে উপস্থিত সবাই এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করতে লাগল। দেখলাম, আসিফও প্রাণের ভয়ে আমাকে রেখেই দিল ভোঁ-দৌড়। কিন্তু বেচারা খুব একটা অগ্রসর হতে পারেনি। দুই কদম সামনে যেতেই হোঁচট খেয়ে লুটিয়ে পড়ল মাটিতে। আমি গিয়ে তাকে টেনে তুললাম। মাটি থেকে উঠে আসিফ আমাকে বলল, দোস্ত... শিগগির পালা। আমাদের মিছিলে বোমা হামলা হয়েছে। বাঁচতে চাইলে এখনই পালাতে হবে। এই বলে সে আবারও দৌড় দিতে চাইল। কিন্তু পারল না। আমি তাকে থামালাম। অবাক হলো আসিফ। বলল, তোর কি জীবনের মায়া নেই? বললাম, আছে। ও এবার রেগেমেগে চেঁচিয়ে উঠল, তাহলে পালাচ্ছিস না কেন? আমি ওপরের দিকে হাত উঠিয়ে তাকে আসল ব্যাপারটা দেখালাম আর বললাম- তোরা যেটাকে বোমা বিস্ফোরণ মনে করেছিস এটা আসলে বোমা না! এটা ছিল বৈদ্যুতিক ট্রান্সফরমার বিস্ফোরণের শব্দ!
শুনে বেশ অবাক হলো আসিফ। সাথে একটু লজ্জাও পেল মনে হয! এরপর সে ওপরে তাকিয়ে বলল, আরে তা-ই তো! দেখ দেখ... এখনো থেমে থেমে আগুনের ফুলকি আর ধোঁয়া বের হচ্ছে ট্রান্সফরমার থেকে!
দেখব এবার জগৎটাকে...
ছোটবেলায় পড়া কবিতার এই লাইন দুটি একেবারে ফেভিকলের আঠার মতো মনের মধ্যে গেঁথে আছে বন্ধু আসিফের! আর তাই সে ঘরের চেয়ে বাইরে ঘুর ঘুর করে সময় কাটাতেই বেশি পছন্দ করে। যেকোনো সভা-সমাবেশ আর রাজনৈতিক মিছিল-মিটিংয়ে আসিফের থাকা চাই-ই চাই। এর মানে এই নয় যে সে একজন সংস্কৃতিমনা মানুষ বা কোনো রাজনৈতিক দলের সক্রিয় সদস্য। আসিফ এগুলো করে বেড়ায় দু-চার পয়সা ইনকাম আর পেট পুরে এক বেলা খাওয়ার আশায়!
আসিফের মুখে শুনেছি, এসব সভা-সমাবেশ আর মিছিল-মিটিংয়ে উপস্থিত থাকলেই নাকি নানা কিসিমের খানাখাদ্য আর কিছু পয়সাপাতিও পাওয়া যায়। আর এসবের লোভে সরকারি-বেসরকারি প্রায় সব দলের মিছিল-মিটিংয়েই যোগদান করত সে।
আসিফের ভাষ্য মতে, সে একজন সাহসী পাবলিক। আর তাই বিভিন্ন দলের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে প্রথম সারিতেই তার অবস্থান। হরতাল, অবরোধ, বিক্ষোভের মতো বড় বড় কর্মকাণ্ডের নেতৃত্বও নাকি দেয় সে। আর প্রতিটি কর্মসূচির পর পরই এগুলোতে তার সাহসিকতার অবদান তুলে ধরে বন্ধু মহলের সামনে। কোন হরতালে কয়টা গাড়ি পুড়িয়েছে, ইটের আঘাতে কয়জন পুলিশকে আহত করেছে এবং কয়টা রিকশার হাওয়া ছেড়েছে- এসব ঘটনা অবলীলায় বলে বেড়ায় বন্ধুদের সামনে। আর এ ঘটনাগুলোই নাকি তার অতি সাহসিকতার নমুনা!
যা-ই হোক, একদিন আসিফ বন্ধু মহলে হরতালের দাওয়াত দিল। মানে রাজপথে মিছিল, ভাঙচুর আর পিকেটিংয়ের নেমন্তন্ন আর কী! আসিফ জানায়, এবারের হরতাল বেশ কড়াকড়ি হবে, তাই এর জন্য অনেক লোকের দরকার। তাছাড়া মিছিলে উপস্থিত থাকলেই নাকি জনপ্রতি ১০০ টাকা এবং এক বেলা খাওয়ারও ব্যবস্থা আছে। দারুণ সুখবর! বন্ধু মহলের সবাই যেহেতু বেকার, তাই ভেবেছিলাম এমন আকর্ষণীয় অফার পেয়ে মিছিলে যেতে সকলে এক পায়ে খাঁড়া থাকবে। কিন্তু না। পরিবারের নিষেধাজ্ঞা আর হামলা-মামলার ভয়ে কেউই আসিফের প্রস্তাবে রাজি হলো না। একমাত্র আমিই রাজি হয়ে গেলাম আসিফের সঙ্গে হরতালের মিছিলে যোগ দিতে। মিছিল করলে টাকা পাব এর জন্য নয়, আমি রাজি হয়েছি বন্ধু আসিফ এত দিন নিজের সাহসিকতার যে গল্পগুজব করে আসছে, সেগুলো কত ভাগ সত্য এটা নিজ চোখে দেখতে।
কথামতো হরতালের দিন সকালে দেখা করলাম বন্ধু আসিফের সঙ্গে। হরতালের পক্ষে বিভিন্ন স্লোগান সংবলিত একটি বিশাল ব্যানার নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আসিফ। আমাকে দেখে ব্যানারটি ধরে দাঁড়াতে বলল সে। আমিও তা-ই করলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই শ-খানেক লোক জড়ো হয়ে গেল মিছিলে যোগ দিতে। আমি আর আসিফ ছিলাম একেবারে প্রথম সারির মাঝামাঝি। ইতিমধ্যেই এলাকার কিছু বড়ভাই ওরফে দলীয় নেতা-কর্মী এসে যোগদান করলেন আমাদের সঙ্গে। আমাদের নির্দেশ দেওয়া হলো, এলাকা থেকে মিছিলটি বের করে শহরের বিভিন্ন অলিগলি আর সড়ক প্রদক্ষিণ করে আমরা যেন আবার নিজ এলাকায়ই সমবেত হই।
বড়ভাইদের নির্দেশে মিছিল নিয়ে সামনের দিকে অগ্রসর হতে থাকলাম আমরা। মিছিলটি এলাকার গলি ছেড়ে মূল সড়কের কাছে যেতেই হঠাৎ শোনা গেল বিকট শব্দ। আর এই শব্দ শুনে কান দুটি একেবারে গরম হয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গেই ধোঁয়ায় ছেয়ে গেল আমাদের চারপাশ। বুঝতে বাকি নেই যে আশপাশে কোথাও ককটেল বিস্ফোরণ হয়েছে। আর তাই মিছিলে উপস্থিত সবাই এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করতে লাগল। দেখলাম, আসিফও প্রাণের ভয়ে আমাকে রেখেই দিল ভোঁ-দৌড়। কিন্তু বেচারা খুব একটা অগ্রসর হতে পারেনি। দুই কদম সামনে যেতেই হোঁচট খেয়ে লুটিয়ে পড়ল মাটিতে। আমি গিয়ে তাকে টেনে তুললাম। মাটি থেকে উঠে আসিফ আমাকে বলল, দোস্ত... শিগগির পালা। আমাদের মিছিলে বোমা হামলা হয়েছে। বাঁচতে চাইলে এখনই পালাতে হবে। এই বলে সে আবারও দৌড় দিতে চাইল। কিন্তু পারল না। আমি তাকে থামালাম। অবাক হলো আসিফ। বলল, তোর কি জীবনের মায়া নেই? বললাম, আছে। ও এবার রেগেমেগে চেঁচিয়ে উঠল, তাহলে পালাচ্ছিস না কেন? আমি ওপরের দিকে হাত উঠিয়ে তাকে আসল ব্যাপারটা দেখালাম আর বললাম- তোরা যেটাকে বোমা বিস্ফোরণ মনে করেছিস এটা আসলে বোমা না! এটা ছিল বৈদ্যুতিক ট্রান্সফরমার বিস্ফোরণের শব্দ!
শুনে বেশ অবাক হলো আসিফ। সাথে একটু লজ্জাও পেল মনে হয! এরপর সে ওপরে তাকিয়ে বলল, আরে তা-ই তো! দেখ দেখ... এখনো থেমে থেমে আগুনের ফুলকি আর ধোঁয়া বের হচ্ছে ট্রান্সফরমার থেকে!
লেখক: রবিউল ইসলাম সুমন
প্রথম প্রকাশ: ঘোড়ার ডিম, দৈনিক কালের কন্ঠ (২৩ ডিসেম্বর ২০১২)

 
No comments:
Post a Comment