Thursday, February 9, 2012

মফিজ যখন হটসিটে!


ই পৃথিবীতে বর্তমানে যতজন হতভাগা আছে তাদের মধ্যে মফিজ এক ও অদ্বিতীয় একজন। সবার ধারনা, মফিজের ভাগ্য লেখার আগেই নাকি উপরওয়ালার হাতের কলমের কালি শেষ হয়ে গিয়েছিলো। আর তাই নাকি তিনি মফিজের কপালে কোন কিছু না লিখেই তাকে এই দুনিয়ায় পাঠিয়ে দিয়েছেন! আবার অনেকে বলেন, ঈশ্বর তার কলমের কালির অভাব মফিজের মাথায় পর্যাপ্ত পরিমান গোবর প্রদান করার মাধ্যমে দূর করেছেন! তো এসব নানান কারণে মফিজের আজ তার নিজের ভাগ্য নিয়ে দূর্ভোগের কোন অন্ত নেই। তবে শোনা যাচ্ছে ইদানীং তার ভাগ্যের চাকা নাকি একটু একটু করে ঘুরতে শুরু করেছে। তার ছেঁড়া-ফাঁটা কপালটা নাকি এখন ফেবিকলের আঠার মত অল্প অল্প করে জোড়া লাগতে দেখা যাচ্ছে। আর তাই ভাগ্যক্রমে সে দেশের নামকরা একটি কুইজ প্রতিযোগিতা ‘কে হতে চায় কোটিপতি’ অনুষ্ঠানে চান্স পেয়ে গেল। কাজেই মফিজকে এখন আর অপদার্থ বলে ডাকার কোন চান্স নেই। মফিজের এলাকা এখন ভীষন গরম। কারণ, তার এলাকা থেকে একমাত্র মফিজকেই টিভিতে দেখার সুযোগ পাচ্ছে সমস্ত দেশের লোকজন। আর এই কথাগুলো ভাবতেই নাকি মফিজের অন্তর চরম উত্তেজনায় ভরে উঠে।
মাত্র কয়েকটা দিনের মাথায় মফিজকে টিভিতে দেখা যাবে। কে জানে হয়তো এই অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করেই মফিজ একদিন দেশের নামি দামি একজন তারকা হয়ে যাবে। তাছাড়া মফিজের চেহারা ও কিন্তু খুব একটা খারাপ না! মফিজের নিজের বর্ননায় তার চেহারায় নাকি অনেকটা নায়ক নায়ক ভাব আছে! আর এজন্যই সে একবার টিভিতে আসতে পারলেই তার কেল্লাফতে!
যাই হোক, দেখতে দেখতে একদিন সেই মাহেন্দ্রক্ষন এসে পড়লো যেদিন কিনা মফিজ বসে আছে কোটিপতির হটসিটে। ষ্টুডিও’র চারপাশ আর টিভি সেটের সামনে প্রচুর লোকজন অপেক্ষা করছে মফিজের কোটিপতি বনে যাওয়ার পর্বটি সরাসরি উপভোগ করার জন্য। মফিজ বসে আছে হটসিটে আর তার পাশের সিটে বসা এই অনুষ্ঠানের হোষ্ট। চারদিকে আছে প্রচুর ক্যামেরা প্রোগ্রামটিকে সরাসরি টিভিতে ধারন করার জন্য। এত লোক, এত ক্যামেরা আর এত এত আয়োজন দেখে মফিজের অন্তরে ভূ-কম্পনের ন্যায় মৃদু কম্পন শুরু হয়ে গেল। অজানা এক ভয়ে তার বুকটা ঘড়ির কাঁটার মত টিক টিক করে লাফিয়ে যাচ্ছে। এরই মধ্যে হঠাৎ চারপাশের লোকজনের তুমুল কড়তালির সাথে সাথে এক, দুই, তিন বলে উপস্থাপক সাহেব কোটিপতির খেলা আরম্ভের ঘোষনা দিয়ে দিলেন।
খেলা চলছে। মফিজের সামনে তার কম্পিউটার স্ক্রীনে একের পর এক ভেসে আসছে প্রশ্ন। মফিজ খুব দ্রুত সেই প্রশ্ন গুলোর ঠিক ঠিক উত্তর দিয়ে সে তার জেতা টাকার অংক বাড়িয়ে নিচ্ছে। একে একে মোট ১২টি প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিয়ে মফিজ জিতে নিয়েছে পুরো ৫০ লাখ টাকা। আবার এজন্য তাকে কোন লাইফ লাইনও ইউজ করতে হয়নি। ব্যাপারটি দেখে উপস্থাপক এবং ষ্টুডিও’র লোকজন মনে মনে বলতে লাগলেন যে, একমাত্র মফিজ-ই পারবে এই অনুষ্ঠান থেকে পুরো ১কোটি টাকা জিতে নিতে। সবার ধারনা সেই হবে কুইজ খেলে দেশের সর্ব প্রথম কোটিপতি। এবারে দর্শক-জনতা হা করে তাকিয়ে আছে অনুষ্ঠানের সর্বশেষ প্রশ্ন অর্থাৎ ১৩নং প্রশ্নের দিকে যার উত্তর দিতে পারলেই মফিজ জিতে নিবে ১কোটি টাকা। দেখতে দেখতেই হঠাৎ কম্পিউটারে ধুম শব্দ করে মফিজের সামনে চলে আসলো এই অনুষ্ঠানের সর্বশেষ প্রশ্নটি। প্রশ্ন হচ্ছে -
আপনার বাবার নাম কী?
আর এই প্রশ্নের অপশন গুলো হচ্ছে যথাক্রমে -
ক) আবদুল জলিল খ) আবদুল কাশেম
গ) আবদুল মজিদ ঘ) আবদুল বাতেন
প্রশ্নটি পেয়ে মফিজ খুশিতে এতটাই আত্মহারা হলো যে খুশির চোটে সে তার নিজের বাবার নাম-ই ভুলে গেলো! এখন তাড়াহুড়ো করে উত্তর দিতে গেলে যদি উত্তর ভুল হয়ে যায় তবে তাকে ১কোটি টাকার বদলে নেমে যেতে হবে মাত্র ৩ লাখ ২০ হাজার টাকায়। আর তাই সে তাড়াহুড়ো করে কোন রিস্ক নিতে চাইলো না। যেহেতু তার হাতে এখনো তিন তিনটা লাইফ লাইন অক্ষত রয়ে গেছে তাই সে এগুলোর সদ্যবহার করার চিন্তা-ভাবনা করল। অতাএব, সে উপস্থাপককে তার লাইফ লাইন নেওয়ার ইচ্ছার কথা জানালো। কথাটি শুনে উপস্থাপক ও জনতা কিছুটা অবাক হলেও খেলার নিয়ম অনুযায়ী তাকে লাইফ লাইন নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হলো। উপস্থাপক জানতে চাইলেন, বলুন আপনি এখন কোন লাইফ লাইনটি নিতে চাচ্ছেন? জবাবে মফিজ জানায় সে, ‘ফোন এ ফ্রেন্ড’ নিতে চাচ্ছে। এরপর কম্পিউটার স্ক্রীনে ভেসে আসলো তিনটি ফোন কলারের নাম। মফিজ এখান থেকে তিনজনের মধ্যে মাঝের জন অর্থ্যাৎ ২নং কলার মিসেস কুলসুম বেগমকে বেছে নেয় ফোন করার জন্য। উপস্থাপক জানতে চাইলেন এই কুলসুম বেগম সম্পর্কে আপনার কী হয়? জবাবে মফিজ জানায়, কুলসুম বেগম সম্পর্কে তার আপন মা! কথাটি শোনামাত্র সেখানে উপস্থিত সবাইকেই উচ্চস্বরে হাসিতে ফেটে পড়তে দেখা যায়! যাই হোক, ফোন করা হলো মফিজের মা মিসেস কুলসুম বেগমের কাছে। অপরপ্রান্ত থেকে ফোন রিসিভ করার সাথে সাথেই উপস্থাপক ফোনে কতক্ষন নিজের ঢোল নিজে পিটিয়ে নিলেন! এরপর মফিজকে দেওয়া হল ফোনে কথা বলার জন্য। আর এজন্য তার হাতে দেওয়া হলো মাত্র ৩০ সেকেন্ড। অতএব, মফিজ ফোনে হায়/হ্যালো না বলেই দ্রুত প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন তার মাকে। বলল,
তোমাকে ৩০ সেকেন্ড সময়ের মধ্যে বলতে হবে আমার বাবার নাম কী?
তোমার অপশন গুলো হচ্ছে -
ক) আবদুল জলিল খ) আবদুল কাশেম
গ) আবদুল মজিদ ঘ) আবদুল বাতেন
মফিজের মা প্রশ্নগুলো শুনে কিছুটা থতমত হয়ে গেলেন! তিনি বুঝতে পারলেন না যে এই প্রশ্ন শুনে তাকে হাসতে না কাঁদতে হবে! যাই হোক, নিজেকে সামলে নিয়ে মফিজের মা হাসতে হাসতে জবাব দিলেন, দেখ বাবা এখানের মধ্যে অপশন ‘ক’ আর ‘খ’ যে তোর বাবার নাম নয় এ ব্যাপারে কোন কনফিউশন নেই। এখন বাকী রইলো ‘গ’ এবং ‘ঘ’ অপশন দুটি। এদের মধ্যে তোর বাবা হচ্ছে… টুট… টু… টুট… নেটওয়ার্ক প্রবলেমের কারণে ফোনের লাইন কেটে গেল! আর সেই সাথে বরবাদ হয়ে গেলো মফিজের প্রথম লাইফ লাইনটি! যেহেতু অপশন ‘ক’ আর ‘খ’ ভুল উত্তর, তাই নিঃসন্দেহে সঠিক উত্তরটি লুকিয়ে আছে অপশন ‘গ’ আর ‘ঘ’ এর ভিতর। এখানে রিস্ক এড়াতে মফিজ আরেকটি লাইফ লাইন ব্যবহার করল, যার নাম হলো ফিফটি ফিফটি। এখন কম্পিউটারের র‌্যান্ডম সিলেকশনের মাধ্যমে দুটি ভুল উত্তর সরিয়ে নেওয়া হলো। ভুল উত্তর সরানোর পর দেখা গেলো বাকী থাকলো ‘খ’ আর ‘ঘ’ অপশন দুটি। ব্যপারটা মফিজের কাছে কেমন জানি ঘোলাটে মনে হলো! আর তাই সে মূহুর্তের মধ্যে কোন উত্তর না দিয়ে সরাসরি তার তৃতীয় ও শেষ লাইফ লাইনটি নিয়ে নিলো। যেহেতু এই লাইফ লাইনটির নাম হলো অডিয়েন্স পুল তাই উপস্থাপক এবার ষ্টুডিওতে উপস্থিত জনগনের কাছে ভোট চাইলেন। এজন্য সবাইকে সময় দেওয়া হলো মাত্র ১০ সেকেন্ড। সময় শুরু হওয়ার কিছুক্ষনের মধ্যেই ভোট প্রক্রিয়া শেষ হলো এবং স্ক্রীনে ভেসে আসলো জনতার ফলাফল। দেখা গেলো ফলাফলে ৯৯% জনতা ভোট করেছে অপশন ‘খ’ (আবদুল জলিল) এবং মাত্র ১% জনতা ভোট করলো অপশন ‘গ’ (আবদুল মজিদ) কে। এবার উপস্থাপক মফিজের কাছে জানতে চাইলেন তার উত্তরটি। তারপর ও যদি উত্তরে কোন প্রকার কনফিউশন থাকে তবে উপস্থাপক সাহেব মফিজকে খেলা কুইট করার আহব্বান জানালেন। মফিজকে নিশ্চুপ থাকতে দেখে উপস্থাপক তাকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি এখন দর্শকদের সাথে যাবেন নাকি খেলা কুইট করবেন? জবাবে মফিজ জানায়, ৯৯% জনতা যখন অপশন ‘খ’ তে ভোট করেছেন তখন এই উত্তরটি আমার মতে কিছুতেই ভুল হতে পারে না।  অতএব, আমি দর্শকদের সাথেই যেতে চাই। অর্থ্যাৎ, আমি ‘খ’ অপশনটিতে আমার উত্তর লক করলাম।
খেলা শেষ। এবার সবাই শুধু চেয়ে রইলো সঠিক উত্তর জানার অপেক্ষায়। উত্তর যদি সঠিক হয় তবে মফিজ হয়ে যাবে কোটিপতি। আর যদি কোন কারণে উত্তর ভুল হয়ে যায় তাহলে মফিজ নেমে যাবে সোজা ৩ লাখ ২০ হাজার টাকায়। অতএব, সবার মনেই এখন টান টান উত্তেজনা বিরাজ করছে। উপস্থাপক তার কম্পিউটার সাহেবকে সঠিক উত্তর জানানোর অনুরোধ জানালেন। কিছুক্ষনের মধ্যেই স্ক্রীনে প্রদর্শিত হলো ফলাফল। কিন্তু একি! চারপাশে হৈ-হুল্লোরের বদলে এক সেকেন্ডেই সব নীরব হয়ে গেল। কারণ, মফিজের উত্তরটি যে ভুল হয়েছে! ব্যপারটি দেখে মফিজ সহ সেখানে উপস্থিত সকলেরই মাথায় হাত উঠে গেল। সবাই নিজ নিজ চেয়ার ছেঁড়ে মাটিতে বসে পড়লেন। এমতাবস্থায় শুধু মাত্র একজনকে দেখা গেলো ষ্টুডিও’তে দাঁড়িয়ে চিৎকার করতে। ব্যপারটি দেখে উপস্থাপক সাহেব ষ্টুডিওতে দাঁড়িয়ে থাকা সেই দর্শকের উদ্দেশ্যে বলতে লাগলেন, আপনিই কি সেই একজন যিনি অপশন ‘গ’ তে ভোট করেছিলেন? জবাবে লোকটি কিছু না বলে দৌড়ে সোজা স্টেজের সামনে এলেন এবং বলতে লাগলেন -
জ্বী, আমিই সেই একজন যে কিনা অপশন ‘গ’ অর্থ্যাৎ, জনাব আবদুল মজিদকে ভোট করেছিলাম। উপস্থাপক বললেন, বাহ্‌… বেশ ইটারেস্টিং তো! এতগুলো অডিয়েন্সের ভিড়ে একমাত্র আপনার-ই কেন মনে হয়েছিলো যে ‘আবদুল মজিদ’ রাইট আনসার হতে পারে? লোকটি এবার দীর্ঘ একটা নিঃশ্বাস ছেঁড়ে বলতে লাগলেন, কেন মনে হবে না? আমার নামই যে আবদুল মজিদ এবং আমিই যে এই মফিজের সেই হতভাগা বাপ! হারামজাদা ছোটবেলা থেকে আমাকে ‘বাবা’ বলে ডাকতে ডাকতে সে যে একসময় তার নিজের বাবার আসল নামই ভুলে যাবে তা কে জানতো!!

No comments:

Post a Comment